সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্রষ্টাভাবনা



প্রথম ভাগ: দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা 

| |

পর্ব-১: উৎসের সন্ধানে

উৎসের সন্ধান করা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। মানুষ তার আশেপাশের জিনিসের উৎস জানতে চায়। কোথাও পিঁপড়ার লাইন দেখলে সেই লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে পিঁপড়ার বাসা খুঁজে বের করে। নাকে সুঘ্রাণ ভেসে এলে তার উৎস খোঁজে। অপরিচিত কোনো উদ্ভিদ, প্রাণী কিংবা যেকোনো অচেনা জিনিস দেখলে চিন্তা করে – কোথা থেকে এলো? কোথাও কোনো সুন্দর আর্টওয়ার্ক দেখলে অচেনা শিল্পীর প্রশংসা করে। আকাশের বজ্রপাত, বৃষ্টি, রংধনু কিংবা সাগরতলের অচেনা জগৎ নিয়েও মানুষ চিন্তা করে। এমনকি ছোট শিশু, যে হয়তো কথাই বলতে শেখেনি, সে-ও কোনো শব্দ শুনলে তার উৎসের দিকে মাথা ঘুরায়। অর্থাৎ, মানুষ জন্মগতভাবেই কৌতুহলপ্রবণ।

একটা বাচ্চা জ্ঞান হবার পর চিন্তা করে – আমি কোথা থেকে এলাম? আরো বড় হবার পর চিন্তা করে – আমার মা কোথা থেকে এলো? এমনি করে একসময় ভাবে, পৃথিবীর প্রথম মা ও প্রথম বাবা, অর্থাৎ আদি পিতা-মাতা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? চারিদিকের গাছপালা, প্রকৃতি, পশুপাখি, গ্রহ-নক্ষত্র-মহাবিশ্ব – এগুলিরই বা সৃষ্টি হয়েছে কিভাবে? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন উৎসুক মনে খেলে যায়।

তখনই শুরু হয় সমস্যা। নিরপেক্ষ মানব মনকে চারিদিক থেকে নানান মানুষ এসে প্রভাবিত করতে শুরু করে। মুসলিম এসে বলে, “আল্লাহ, সবকিছু আল্লাহর সৃষ্টি।” হিন্দু এসে বলে নানান দেব দেবীর কথা। খ্রিষ্টান এসে বলে খোদার পুত্র যীশুর কথা। কিংবা হয়ত নাস্তিক এসে বলে, “ঈশ্বর/ ভগবান/ আল্লাহ বলে কিছু নেই।” শুরু হয় একটা নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত পরিচ্ছন্ন মনের শিশুকে ধর্ম কিংবা ধর্মবিরোধী ব্রেইনওয়াশিং দেয়া। আর তাই মুসলিমের সন্তান মুসলিমই হয়, হিন্দুর সন্তান হিন্দুই হয়, খ্রিষ্টানের সন্তান খ্রিষ্টান, এবং নাস্তিকের সন্তান নাস্তিকই হয়।

এবং সেখানেই শেষ না। এরপর শুরু হয় বেচারাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া। সবাই ডাকতে শুরু করে যার যার ধর্মের দিকে। কিংবা নাস্তিক আহবান করে নাস্তিকতার দিকে। শুরু হয় আস্তিক-নাস্তিক, হিন্দু-মুসলিম, কিংবা মুসলিম-খ্রিষ্টান বিতর্ক দিয়ে দ্বিতীয় দফার ব্রেইনওয়াশিং। তারপর সেটা চলতেই থাকে। এতসব ধর্মীয় তর্ক বিতর্কের মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে আমরা কেউ কি একটিবারের জন্যে হলেও একটু থেমে চিন্তা করে দেখি যে, আমাদের নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত মনটাকে আমরা সেই শিশুকালেই ফেলে রেখে এসেছি?

তারপর কোনো নতুন ধর্ম গ্রহণ করা বা ধর্মত্যাগের কারণে হারাতে হয় পরিবার, সমাজ ও বন্ধু-বান্ধবের ভালোবাসা! না আমাদের সমাজ, পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব আমাদেরকে একটু সময় দিতে চায়, আর না আমরা নিজেরা নিজেদেরকে একটু সময় দিই! কেউ-ই তো সেই নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত শিশুমনে ফিরে গিয়ে শুরু করতে চাই না! চেষ্টা করি না!

কোনো বিশেষ ধর্মের পক্ষেও নয়, বিপক্ষেও নয়; বরং নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত মানবমনে “স্রষ্টাভাবনা” কেমন হতে পারে, সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এই বইয়ে। তাই এই বইটি কেবল তাদের জন্যে, যারা ধর্ম সংক্রান্ত নানান তর্ক-বিতর্কের ভিড়ে একটু থেমে দম ফেলতে চান, নিরপেক্ষ-অপ্রভাবিত একটি মন নিয়ে সত্য অনুসন্ধান করতে চান। তেমনই এক যাত্রায় আপনাকে স্বাগতম।

নূরে আলম মাসুদ
জানুয়ারি ২০১৮, ঢাকা।




মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক জনপ্রিয়

খোদার ন্যায়বিচার | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: আল্লাহ কেন পথভ্রষ্ট করেন? | সূচীপত্র দেখুন প্রশ্ন: এমনও অনেকে আছে, যারা ইসলামের নামও শোনেনি, যাদের কাছে কুরআন পৌঁছায় নাই, তাদের কী হবে? তারা কেন জাহান্নামে যাবে? তাদের কী দোষ? কোথায় খোদার ন্যায়বিচার? নাস্তিকদের একটা কমন প্রশ্ন এটা। এবং প্রশ্নটা অবশ্যই অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মুসলমানই ইসলামকে যৌক্তিক ও দার্শনিক মানদণ্ডে যাচাই করে তারপর সত্য হিসেবে গ্রহণ করে মানে না, বরং তারা মানে বাপ-দাদার ধর্ম হিসেবে, (অন্ধ)বিশ্বাসের বস্তু হিসেবে। আর তাই এসকল প্রশ্নের যৌক্তিক সত্য জবাবও তারা দিতে পারেন না। দেবেনই বা কিভাবে, নিজেই তো জানেন না! উপরন্তু নিজের (অন্ধ)বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্য গোঁজামিলে পরিপূর্ণ ভুলভাল ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাই তারা বলেন, “মুসলমান না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না। অমুসলিম মাত্রেই জাহান্নামী”, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ একটা পতিতালয়ে যে মেয়েটির জন্ম হয়, সে মেয়েটি কী দোষ করেছিল তাহলে? ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এমন সব প্রশ্নকে দূরে ঠেলে “মুসলিম না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না ব্যস” বলে বসেন। অথচ জন্ম ও বেড়ে ওঠার উপর কারো হাত নেই। দুনিয়ার প্রতিটা মানুষই ভিন্ন ভ

আত্মদর্শন | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: জ্ঞানের জগত ও হৃদয়ের জগত | সূচীপত্র দেখুন আমি কে? “I am not this hair, not this skin But the soul that lies within.” - Maulana Rumi আমি কে - এই প্রশ্ন যুগে যুগে দার্শনিকদেরকে চিন্তিত করেছে। অনেকে বলেছে, মানব মস্তিষ্কেই কেবল আমিত্বের অনুভূতি বিদ্যমান। কথা হয়ত সত্য। তবে যেহেতু তারা ক্বলবের জগত সম্পর্কে বেখবর, তাই তারা তাদের সীমিত জ্ঞানবৃত্তের ভিতরেই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে। মানুষের আত্মা হলো আসল খলিফা وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ (١٧٢) أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ (١٧٣) “আর (হে রাসূল!) যখন আপনার রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বহির্গত করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং তাদের নিজের ওপর তাদেরকে সাক্ষ্য করলেন; (তাদেরকে প্রশ্ন করলেন,) আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল, অবশ্যই, আ